কাঠফাটা খরার পর কয়েক দিনের বৃষ্টিতে জয়পুরহাটে আমন ধানের রোপন মৌসুম প্রায় শেষ হয়েছে। রোপনের এক মাস পরেই সার ছিটিয়ে দিতে হবে ধানখেতে। এরই মধ্যে ইউরিয়া সারের দাম কেজিতে ৬ টাকা ও বস্তায় ৩শ টাকা বেড়ে গেছে, ফলে মজুতদার ও ব্যবসায়ীরা নতুন দামে বিক্রির নানা কৌশল নিয়েছেন। কেউ দোকান বন্ধ রাখছেন কেউ আবার বলছেন দোকানে সার নেই। এদিকে কৃষি বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছেন কৃষকরা আলুর জন্য আগাম সার মজুত করার কারণে সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
জয়পুরহাটের কৃষকরা বাজারের সাব-ডিলারদের (খুচরা) দোকানগুলোতে ইউরিয়া সার পাচ্ছেন না। বিসিআইসির অনুমোদিত ডিলারদের দোকানে গিয়েও কৃষকদের চাহিদা অনুযায়ী সার দেওয়া হচ্ছে না। ডিলারদের দোকানে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর পাঁচ-দশ কেজি করে ইউরিয়া সার দেওয়া হচ্ছে বলে কৃষকরা অভিযোগ করেছেন। তাও আবার ক্যাশ মোমো ছাড়া। বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) সরকারি সার গুদামের কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার বিশ্বাস জানান, গত ৩ মাস আগেও ইউরিয়া সারের দাম যেখানে ছিল প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) ৮০০ টাকা, এখন সেখানে ১ হাজার ১০০ টাকা। গুদামে পর্যাপ্ত পরিমাণ ইউরিয়া সার মজুত আছে বলেও জানান তিনি।
সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, আমন ধান রোপনে ব্যস্ত সময় পার করছেন জয়পুরহাটের কৃষকরা। নিয়ম অনুযায়ী রোপনের ২-৩ সপ্তাহ থেকে ১ মাসের মধ্যে সার ছিটিয়ে দিতে হবে ধানখেতগুলোতে। তাই ধান রোপনের পাশাপাশি সার সংগ্রহে চাষিদের দৌড়াতে হচ্ছে ডিলার ও বিক্রেতাদের কাছে। এরই মধ্যে সারের মূল্য বৃদ্ধিতে উদ্বিগ্ন তারা। খুচরা দোকানে গিয়ে সার পাচ্ছেন না। বিসিআইসির অনুমোদিত ডিলারদের দোকানে অনেক সার আছে, কিন্তু খুচরা দোকানে তারা চাহিদা অনুযায়ী সার পাচ্ছেন না। তারপরও তারা ডিলারদের দোকানে গিয়ে অনেক সময় ব্যয় করে ক্যাশ মোমো ছাড়াই অল্প পরিমাণে সার কিনছেন।
জয়পুরহাট সদর উপজেলার পুরানাপৈল রেলগেট এলাকার প্রান্তিক চাষি নাসির হোসেনসহ জেলার অন্যান্য কৃষকরা জানান, তারা আমন ধানের চারা রোপন ইতোমধ্যে শেষ করেছেন, ৩ সপ্তাহ থেকে ১ মাসের মধ্যে তাদের ইউরিয়া সার ছিটিয়ে দিতে হবে জমিতে। কিন্তু এখন সার সংগ্রহ করতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। এরপরও সার ব্যবসায়ীরা চাহিদামতো সার দিচ্ছেন না। আক্কেলপুরের কৃষক এনামুল হক বলেন, খুচরা দোকানে গিয়ে ইউরিয়া সার পাইনি, তাই ডিলারের দোকানে এসেছি। আমাকে দশ কেজি ইউরিয়া সার দিয়েছে। আমার প্রয়োজন এক বস্তা (৫০ কেজি) ইউরিয়া সার। আর সার কোথায় পাই সেই চিন্তাই করছি।
খুচরা সার ব্যবসায়ী সুজন কুমার মণ্ডল বলছেন, বিসিআইসির অনুমোদিত ডিলাররা তাদের চাহিদা অনুযায়ী সার দিচ্ছেন না। আবার দামও বেশি নিচ্ছেন। সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে তাদের বেশি দামে সার বিক্রি করতে হচ্ছে। প্রশাসনের কড়া হুঁশিয়ারি ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের ভয়ে ডিলাররা দোকানে সার বিক্রি বন্ধ রেখেছেন। তাদের অভিযোগ, ডিলাররা নাকি এ মাসে সরকারিভাবেই সারের বরাদ্দ কম পেয়েছেন। তাই তারা চাহিদা মোতাবেক সার দিচ্ছেন না। আক্কেলপুর কলেজ বাজারের খুচরা সার (সাব-ডিলার) বিক্রেতা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, অনুমোদিত ডিলাররা তাদের সার দিচ্ছেন না। আবার সারের যে দাম নিচ্ছেন, তাতে নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দাম বিক্রি না করলে লোকসান হবে। আবার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দাম নিলে ভ্রাম্যমাণ আদালতে জরিমানা করা হচ্ছে। এসব কারণে তারা সার বিক্রি করছেন না।
এদিকে আক্কেলপুর পৌর শহরের বিসিআইসির ডিলার মেসার্স আবু তালেব সরদার এবং কালাই পৌর শহরের পাঁচশিরা বাজারের বিসিআইসির ডিলার মেসার্স কালাই রাইচ মিল নামক হুমায়ন কবির তালুকদারের দোকানে কৃষকদের সার নিতে ভিড় করতে দেখা গেছে। তবে ডিলার ও ব্যবসায়ীরা বলছেন কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে সারের মূল্য বৃদ্ধির কোনো সুযোগ নেই। যদি কেউ তা করে থাকেন, তার দায়ভার তাকেই নিতে হবে। জয়পুরহাট জেলা শহরের ডিলার মিজানুর রহমান মিন্টু, সদর উপজেলার হানাইল চল্লিশ পীর দরগাহ এলাকার গোলজার হোসেন, ক্ষেতলাল উপজেলার নিমতলী এলাকার সার ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেনসহ ব্যবসায়ীরা এমন মন্তব্য করে জানান, সরকারের নির্ধারিত দরেই তারা সার বিক্রি করছেন। আক্কেলপুরের বিসিআইসির ডিলার আমিনুল ইসলাম ও কালাইয়ে বিসিআইসির ডিলার হুমায়ন কবির তালুকদার বলেন, সারের জন্য এ পর্যন্ত কোনো কৃষকই ফেরত যাননি। পর্যাপ্ত সার না থাকায় কম-বেশি করে কৃষকদের দেওয়া হচ্ছে। আর খুচরা ব্যবসায়ীদের দেওয়া হচ্ছে না। তবে বরাদ্দ বেশি পেলে অবশ্যই তাদেরও সার দেওয়া হবে।
আক্কেলপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইমরান হোসেন বলেন, সারের কোনো সংকট নেই। কৃষকরা আমন মৌসুমে অযাচিতভাবে আগামী আলুর জন্য অগ্রিম সার মজুত করছেন। এ কারণে কৃষকদের কম পরিমাণে সার দেওয়া হচ্ছে। দাম বেশি নেওয়া এবং মেমো ছাড়াই সার বিক্রি হচ্ছে এ বিষয়ে তিনি বলেন, কিছু কিছু দোকানে দাম বেশি নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। গত কয়েক দিন ধরে এসব দোকানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে জরিমানা আদায় করা হয়েছে। তাছাড়া এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।
এ দিকে সার সংকটের অভিযোগ অস্বীকার করে জয়পুরহাট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. শফিকুল ইসলাম জানান, জয়পুরহাটে এ মৌসুমে ৬৯ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে রোপা আমন ধান চাষের জন্য ৩ মাসে ৮ হাজার ৬৯৫ টন ইউরিয়া সার মজুত আছে। এ মজুত পর্যাপ্ত, তাই সারের কৃত্রিম সংকট যাতে না ঘটে, তাই নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে বলে জানালেন জেলার প্রধান কৃষি কর্মকর্তা। জয়পুরহাট জেলা প্রশাসক শরীফুল ইসলাম বলেন, সারের কোনো সংকট নেই। কৃষকেরা আলুর জন্য আগাম সার মজুত করছেন বলে জানতে পেরেছি। কারণ, জেলার সবচেয়ে বেশি আলুর আবাদ এই দুই উপজেলায়। যদিও কেউ সারের দাম বেশি নেন তাহলে ওই দোকানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
Leave a Reply