জীবন থেকে নেওয়া সফল উদ্দ্যোক্তা সাওদা আফরিন সরকার । ১৯৮৮ সালে শরতের এক উজ্জ্বল সকালে ঘর অন্ধকার করে জন্ম নেয় একটি কন্যা শিশু। পাঠকের মনে প্রশ্ন এ কেমন কথা, শুরুতেই নেতিবাচক শব্দ! জি অন্ধকার! আমার জন্মের সাথে সাথে আমার বাবার দোতলা বাড়ি মাথায় করে চিতকার জুরে দিয়েছিলেন আমার নানী। কারণ আমি বাবার ৪র্থ কন্যা। বাবাও ভেবেছিলেন এবারও ছেলেই হবে। বাবা যেনো ছেলের আল্লাদ দিয়েই মানুষ করছিলেন আমাকে। আল্লাহ পাক আমাকে ভীষণ ভালোবেসে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন আমার জন্মস্থান বগুড়া। আমার শৈশব বগুড়া, বাগেরহাট এবং ঢাকা মিলে কেটেছে বাবার কর্ম সুত্রে। বাবা একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। বর্তমানে অবসের আছেন। মা গৃহিনী। আমার কৈশোর কাটে ঢাকায়। বাবার অবসরে আবার যেনো নীড়ে ফেরার পালা। যেহেতু বগুড়ায় নিজেদের বাড়ি। বগুড়া ফেরার পরে থেকেই বিয়ে বিয়ে বিষয় টি পরিবারের মাথায় উঠে যায়।
ধর্মীয় অনুভুতি থেকে পর্দার জন্য পড়া বন্ধ করে করা হয় বিয়ের আয়োজন। আল্লাহ পাক ভালোবেসে দান করলেন নতুন জীবন। পারিবারিক আয়োজনে বিয়ে হয় আমার। ১১ বছরের বর্নিল সংসার জীবন আমার। বিয়ের আট মাসেই কিছু শব্দ দুষন হয়ে কানে বাজে,”সাওদার বাচ্চা হচ্ছে না”। বিয়ের পর থেকে টুকটাক অর্ডারের কাজ করতাম, খুবই কাছের মানুষজনের অর্ডার থাকত সেসব। আল্লাহ পাক আমাকে সৃষ্টি করেছেন সৃজনশীল মগজ দিয়ে। সেলাই, সৃজনশীলতা আমাকে ভীষণ টানে। শিশুকাল থেকে বড়ো বোনে সেলাই রেখে উঠে গেলে দু এক ফোর তুলতাম। সেলাই মেশিন ছেড়ে উঠে গেলে মেশিন চালাতাম। ইচ্ছে, শখ এবং একাকিত্ব থেকে বিষয়টি গুরুত্ব পায় ২০১৩ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর। শুরু করেছিলাম প্রভুর নামে। বছর ঘুরতেই মাত্র ২৫০০ টাকায় শুরু করে মুলধন দাড়ায় ২ লাখে। ৩ জন কর্মী হয় ৮ জন। ২০১৬ সালে স্বামীর মুখে ২য় জীবনের কথা শুনে অসুস্থ হতে থাকি। আমার শিশু উদ্যোগটিও মুখ থুবড়ে পড়ে। আল্লাহ পাকই একমাত্র জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান। ২০১৬ থেকে স্বামী চান ২য় জীবনের অনুমতি। ২০১৬,১৭,১৮ দিইনি অনুমতি। তৈরি হয়েছে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা। ২০১৯ এ ইতিবাচক ভাবে সিদ্ধান্ত নিই স্বামীর সাথে আলাদা থাকবার।
শুরু করি পড়াশোনা। ২০২০ এ স্বামী ২য় জীবন শুরু করেন। পৃথিবীর অসুখ হয়, জীবন থেমে যায় চার দেয়ালে। আল্লাহ পাক সুক্ষ্ণ পরিকল্পনাকারী ১৬-২০ টুকটাক পুরনো ক্রেতাদের ধরে রেখেছিলাম, বড়ো অর্ডার নেয়া বন্ধ ছিলো। আমার কাজ বন্ধ এটা কখনো প্রকাশ করতাম না। কেউ কিছু চাইলে আমি অন্য সোর্স থেকে এনে হলেও ক্রেতা ধরে রাখতাম। আমার কর্মীদের দিয়ে দিতাম অর্ডার। শারীরিক, মাণষিক আর্থিক, পারিবারিক সব দিকে বিপর্যয় অবস্থা। তবুও যেনো হাল ছাড়ি নি। ২০১৭ তে ফেইসবুকে একটি গ্রুপে যুক্ত হই। কমেন্ট বাংলায় লিখতে হবে। ইংরেজিতে কমেন্ট করলে গ্রুপের সবাই ভীষণ তাড়া করতো। অনেক দিন ছিলাম গ্রুপ টিতে।তাড়া খাওয়ার ভয়ে আর ওখানে একটিভ থককি না। এটা স্মৃতিতে ছিলো। আমার ছিলো ডায়েরি লেখার অভ্যাস, ২০১৭ এর ডায়েরি খুলে স্মৃতি চারণ হয়। ২০২০ এ আমি ভীষণ পারদর্শী বাংলা টাইপে। একটু তাচ্ছিল্য ভরে নতুন করে গ্রুপে গিয়ে দেখি অজানা এক রাজ্য। অনেক গোছানো। বাংলার সকল গুণবতী নারীর রাজত্ব। নারীর এক স্বর্গ রাজ্য। নারীর সফলতা। অজানা এক নেশায় পেয়ে যায় আমাকে।
গ্রুপে দেখতে পাই জান্নাতুল ফেরদৌস মহুয়া কে। মহুয়া যদি পারে আমি কেন নয়। মহুয়া আমার জীবনের অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে। আর সেই গ্রুপটি আমাদের, নারীদের প্রিয় “Women and E-commerce Platform”. এবার শুধু শখ নয়, কিছু প্রাতিষ্ঠানিক রুপে এগিয়ে যেতে শুরু করি। এক মাত্র আল্লাহ পাক ই রিজিক দাতা। ২০২১ মার্চে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হন আব্বা, তারপর আম্মা আব্বা আম্মার সেবা করতে করতে নিজেও আক্রান্ত হয়ে যাই। প্রথমে আমার নেগেটিভ আসে,তারপর আব্বার, তারপর আম্মার। নেগেটিভ আসে ঠিকই কিন্তু আম্মা শারীরিক ভাবে আরও দুর্বল হয়ে যান। প্রতিদিন একেকটি অর্গানের দুর্বলতা সম্পর্কে জানাতে থাকেন চিকিৎসকগণ। মাণষিক প্রস্তুতি নিতে বলে দেন। ২০২১ এর রমজানে আম্মা জান্নাত বাসী হন। এক মুহুর্তে বড়ো বোন দের মা,ভাই হয়ে উঠি। যেনো শিশুর হাতে মন্ত্রীত্ব। শুরু হয় আমার আর আব্বার সংসার জীবন। পঁচাত্তর উর্ধ্ব,৫৮ সংগী হারা, অসুস্থ বাবা। অন্য দিকে আমার সন্তানতুল্য শিশু উদ্যোগ। কোভিড সংক্রান্ত দুর্বলতা কাটতে আব্বার লাগে ছয় মাস। ঘর ছেড়ে বের না হওয়া একটা ট্রমায় পরিনত হয়।
এ ছয় মাসে একটি ছায়া আমার পাশে ছিলেন। আমাদের বগুড়ার একজন উদ্দোক্তা নাদিরা হাসান। আপা আমাকে প্রতিদিন একটু একটু করে বের করে আমার ভেতর থেকে। সেপ্টেম্বরে প্রথম ঘর ছেড়ে বের হই নাদিরা আপার হাত ধরে। WE এর মাসিক মিটিং এ। পাশে পেয়েছি আমাদের জেলা প্রতিনিধি তাজরীন তামান্না লুবা আপু কে। সহ প্রতিনিধি আরাফাতুন ফেরদৌস রেইনি নিজের মুখের খাবার টুকু আমার জন্য তুলে রাখেন। তারিখ পরিবর্তন হয় কিন্তু আমাকে অনুপ্রাণিত করে যাচ্ছেন সৈয়দা রাজিয়া বিল্লাহ ইরা আপা, রাত যখন গভীর তখনও সকল প্রশ্ন যাকে করা যায় সে জিনিয়া আফরোজ এমি আপু। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাইনি। শিখছি প্রতিদিন। WE যেনো একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
প্রতিদিন কোনো না কোনো ক্লাস থাকে আমাদের। এছাড়াও রয়েছে কিছু ডিজাইন করা ক্লাস সমুহ। Master Class, Soft skill development, সুযোগ করে দিয়েছে Amazon এর সাথে কাজ করার। WE উদ্দোক্তাদের কাছে Export কোনো কঠিন শব্দ নয়। গত ছয় মাসে প্রায় আড়াই লাখ সেল। স্পনসর করেছি বিভিন্ন জায়গায় প্রায় ৮০০০ মুল্যের কাছাকাছি। বাড়ছে কর্মীদের সংখ্যা। বাড়াচ্ছি পণ্য। আগাচ্ছি দক্ষ শক্তিতে। তবে সেল আমার বর্তমান লক্ষ্য নয়। আমি এখন WE শিক্ষার্থী। সংসারের চাপে নেতিয়ে পড়া জীর্ণ মানুষ ছিলাম আমি।আমি নারী ছিলাম। যাকে ইচ্ছে হলেই ছুড়ে ফেলা যায়। যার উপর সিদ্ধান্ত চাইলে চাপিয়ে দেওয়া যেতো। আমি অমুকের কন্য, তমুকের স্ত্রী। আমি মানুষ। আমি সাওদা। ২০২২ এ আমি সাওদার যোগ হয়েছে এস এস সি সার্টিফিকেট।পড়ছি এইচএসসি তে। আমি সাওদা আফরিন সরকার। আমি নারী, আমিই পারি। WE মানে আমরা। WE এগিয়ে যাওয়া।
আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সঙ্গে থাকুন: www.fb.me/bd.ichamotinews
উদ্দোক্তাদের পাশে থেকে অণুপ্রেনিত করার জন্য ধন্যবাদ। সাওদাকে অভিনন্দন।